যোগাযোগ

শুভঙ্কর দাশের কবিতা

বড়িচূড়া

বহুকাল আগে এক মাদ্রাজি প-িত বলেছিল
গত জন্মে আমি নাকি জন্মেছিলাম উত্তর কলিঙ্গে।
বলে কী ব্যাটা?
কোথায় বলবি ইয়োরোপে জন্মেছিলাম,
এ জীবনে কষ্ট করে বাঙালি হয়েছি
তা না, যতসব আতোল বাতোল।

এই দশ দিন ওড়িশায় কাটিয়ে দেখি
এদেরও ভাত বড় প্রিয়।
গতরাতে খানিকটা ভাত বেঁচে গেছিল বলে
জল ঢেলে রেখেছিলাম।
সকালবেলায় কাঁচা পেঁয়াজ আর
কাঁচা লঙ্কার আচার দিয়ে মেরে দিলাম
সপাসপ।

এখানে ঘেমে ওঠা কাঁচ ঢাকা ঠা-ী রেস্টুরেন্টের
ছাপানো মেনুতে দেখি সসম্মানে জ্বলজ্বল করছে
পক্ষাল ভাত।
আহা দেখে আমার গর্ব হচ্ছিল খুব।
এরাই বুঝেছে পান্তা ভাতের মর্ম ঠিকঠাক।
সঙ্গে যদিও বড়িচূড়া থাকতেই হবে।

আহা এরা বড়িও ভালোবাসে দেখি।

ডালের ছোটো সাদা বড়ি শুকনো খোলায় নেড়ে
নামানোর আগে একটু নুন আর তেল দিয়ে নিতে হয়।
যেমন ভাবে বড়ি ভাজে আর সবাই
তার থেকে বেশি কিছু নয়।
তারপর গোটা পাঁচেক কাঁচা রসুনের কোয়া
আর গোটা চারেক কাঁচা লঙ্কা দিয়ে
বড়ি সহ মিক্সিতে ঘুরিয়ে নিলেই কেয়াবাৎ।
এক থালা গরম ভাতও উড়ে যাবে নিমেষে।
যেভাবে ওড়ালাম আমি দুপুর বেলায়।

কোলকাতায় ফিরেই বানাতে বসতে হবে।
গত জন্মের এই স্বাদ আরেকবার পেতে চাই আমি।

অবশ্য তার আগে আমার একলা ঘরে
একটা মিক্সির বড় প্রয়োজন।

 

না কাটা দাঁড়ি

এ কদিন বাজারে সেলুন খুঁজিনি
এ কদিন ওষুধের পাউচে রাখা
তেল শ্যাম্পুর শ্যাসের জন্য
মন খারাপ করেনি একটুও।

ফিরে এসেছি জঙ্গলের গন্ধ মেখে
ফিরে এসেছি নদীর জলে গা ভিজিয়ে
পোড়া ডিজেলের আশ্বাসের কাছে।

ফিরে এসেছি আমার প্রেমিকা
কফি মেশিনটার কাছেও।
যে আমাকে আদর করে এখন
এক কাপ কড়া ভালোবাসা উপহার দেবে।

যার গন্ধে ভুরভুর করবে
এ ঘরের অন্তর অন্দর।
আর আমাদের বৃষ্টি ভেজা স্বপ্নেরা।

 

কেন যে

চোখ বুজলেই তোর হাসি মুখটা
কেন যে দেখতে পাচ্ছি বার বার?
কেন যে ভালো লাগছে
তোর কথা ভাবতে?

অথচ আমরা তো বিস্তীর্ণ মাঠে
ঘাসের ভেতর ভালবাসা খুঁজতে
চুপি চুপি হাঁটতে যাইনি
সে কোন ভোরবেলায়।

শুধু একা একা শোনার চেষ্টা করেছি
গাছেদের কথা।
হাওয়ার সে কোন আশ্বাসে
বাসি মুখের ধোঁয়াদের উড়িয়েছি।

আর দেখেছি সিগারেটের জ্বলে যাওয়ার
কষ্টটুকু।

 

সাজান ফাঁকের ফোকরগুলো

পৃথিবীর যাবতীয় খাট পালঙ্ক
কেন যে দেওয়াল ঘেঁষে থাকে?
ঘরের মাঝ বরাবর থাকতে পারে না
সেটা কী এ জন্যে যে মানুষ আসলে
আশ্রয় খোঁজে দেওয়ালের কাছে।
দেওয়ালের কাছেই সে জানাতে পারে
তার সব অভিমান
তার সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষাগুলো।

দেওয়ালের কোণে সে মুখ লুকিয়ে
স্বপ্নের কাছে প্রার্থনা করে?

কোলবালিশ নিয়ে পাশ ফিরতে গিয়ে
হাঁটুতে রাম ঠোক্কর লাগার পর ভাবছি
এ বয়েসে কী মানাবে আর ফুটবল খেলা?

বরং খাটটা টেনে ঘরের মাঝ বরাবর
করে নেওয়া ভালো।
না হলে দেওয়াল ঢাকতে এত বালিশ
আমি কোথায় খুঁজতে যাব?

 

ক্যামেরা ইত্যাদি

ক্যামেরার লেন্স কী মেয়েদের ভালোবাসে খুব?
নাহলে এত মায়াময় ছবি
কী করে সে জন্ম দেয়?
কপালে টিপের তেরছা হয়ে যাওয়ার মতো।

ক্যামেরা কী আসলে একটা পুরুষের চোখ?

তবু সে যতই চেষ্টা করুক না কেন
মন দিয়ে আনমনা সেলফি তোলার মজা
শুধুমাত্র মেয়েরা জেনেছে।

আমি এইসব চুপচাপ দেখি
এইসব ডকুমেন্টেশান
ছবির রাজনীতি
আমিও তো বুঝি কিছু কিছু।

কিন্তু এসব কিছুর ভেতরেও
থেকে যায় বোকামি দুর্বলতা
মানুষের।

যা দেখে হাসি হেসে ফেলি
স্ক্রোল ডাউন করে বেরিয়ে যাই
অন্য কারো কাছে।

পৃথিবী যে অনেকটা বড়
একথা কী এতদিনেও জানলো না এরা?

Featured post

যশোর রোড

যশোর রোড
সময়রে সুতীব্র সাহস ও অনিবার্য পদ্ধতি…
Continue reading “যশোর রোড”

Featured post

যোগাযোগ

 

https://commons.wikimedia.org/wiki/User:Jessoreroadbd

 

Featured post

বুনো শুকর, পুঁজির দেবতা আর বিজ্ঞাপনের পরীর গল্প-ঋষি এস্তেবান

0

গল্প আর গল্পকার নিজেদের ব্রীজ পার করে ওয়াচটাওয়ারে তোলে…

পাখিনামা বিলের পাড়ে ওয়াচটাওয়ার বানিয়েছে এক এন জি ও ব্যাপারী যার উপরে এক দূরবীনসহ অপারেটর রক্ষিত। ওয়াচটাওয়ারে ওঠা আর যন্ত্রে পাখি দেখার জন্য এনজিও ব্যাপারী পঞ্চাশ টাকা আদায় করে জনপ্রতি।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রবল শীতের তাড়া খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে আসা শরণার্থী পাখিদের কেন্দ্রকরে লাভালাভের ষড়যন্ত্র থেকে এনজিও ব্যাপারীরা পাখিদের নিরাপত্তার অজুহাতে কয়েকজন দারোয়ান নিয়োগ দিয়ে দখল কায়েম করেছে। এখানে আরও মিডিয়া, ফিচার, ডকুমেন্টরি, গবেষণা ব্যাপারীরা অসহায় পাখিদের নিয়ে ব্যাপক মুনাফাখোরি কারবার খুলে বসেছে মানবতার মুখোশের গোপনে।

গল্প গল্পকারকে বলে ‘তুই এক সন্দেহ বিকারগ্রস্ত নৈরাজ্যবাদী’
‘কার বা কোথায় তাতে সমস্যা হচ্ছে?’
‘ চালাক-চতুর সফল মানুষেরা বলে উড়নচ-ীগিরি না করে নিজেদের বাজারে তুল্লে প্রচুর অর্থ নাম অর্জনের সম্ভাবনা আছে।’
‘যে বা যারা প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া শ্রম এবং মেধাশক্তি কোনো মুনাফা খোরের মুনাফা বানানোর কাজে নিয়োজিত না করে নিজের স্বাধীন ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে মাথা উঁচু করে ঘোরে-ফেরে এমন মুক্ত প্রাণকে প্রতিষ্ঠান তার চাকর, প্রতিনিধি, মালিকরা উড়নচ-ী বলে। প্রতিটা শব্দ-বাক্য ওরা ওদের লাভের হিসাব থেকে ব্যাবহার করে, আমাদের শব্দ বাক্য বিষয় আমাদের মতো প্রস্তুত করে নিতে হয়। পৃথিবীর সব বাজারের কুকুর একই সুরে ডাকে, স্বাধীন প্রাণের স্বর আলাদা।’
‘কেউ কিছু না, একেকজন একেকরকম সাজে মৃত্যুর দিকে যেতে কেউ স¤্রাট আলেকজান্ডার কেউ ভুসিমালের ব্যাপারী আলেক মোল্লা। মুলতঃ আমিই বাঁচি আর বাঁচায় রাখি কাউকে বা কোনো ঘটনাকে বাকি সব সময় গিলে হজম করে ফেলে। আমার মাঝে একাকার হয়ে আমার অংশ হবার জন্য মানুষেরা কি না করে? কেউ সাঁতরিয়ে পার হয় ইংলিশ চ্যানেল, কেউ বুকে মাইন বেঁধে লাফ দেয় ট্যাঙ্কের নীচে, লক্ষ-কোটি টাকা খরচ করে কেউ বড়বড় স্থাপনা তৈরি করে। যে কোনোভাবে সবাই চেষ্টাকরে নিজের সাথে একটা গল্প জুড়তে। জগৎ সংসার গল্পের সমাহার, এইযে তোর সামনে একটা সাপ, তার বিষের কাহিনীসহ, ওর উপরে ওর বিপরীত গল্পটা প্রয়োগ করলে ওর প্রথম গল্প শেষ। ওকে লেজ ধরে শূন্যে তুলে একটা ঝাকি দে, কাটার জোড় খুলে ওর জীবনের গল্পকে হটিয়ে ওকে দখল করবে মৃত্যুর গল্প।

গল্প আর গল্পকার কথা বলতে বলতে চলে আসে পৃথিবীর এই অঞ্চলে যেখানে সবচে’ কমদামি চালের দাম কেজি চুয়ান্ন টাকা, একখানা মাঝারি গামছা একশ ষাট টাকা, তিন শ টাকা, যে কোনো সাধারন ডাক্তারের নজরানা, বিশেষজ্ঞ’র ফি এর দ্বিগুন। এক কেজি মসুরের ডাল এক শ ষাট টাকা, তিন শ টাকার নীচে কোনো লুঙ্গি পাওয়া যাবে না, সবচে’ কমদামি শাড়ি পাঁচ শ টাকা, সেখানে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক মুজুরী ঊনসত্তর টাকা, হিসাবের এপর্যায়ে গল্প গল্পকারের মাথার ভিতরে ঢং ঢং ঘণ্টা বাজিয়ে বিজবিজ করতে থাকে। গল্পকার হেকে ওঠে ‘বেরিয়ে আয় ঝি ঝি ধরিয়ে ঘিলু অবশ করে ফেলছিস তুই আমার।’

‘গামছা, চাল, ডাল, শাড়ি, লুঙ্গি, দৈনিক মুজুরী, ডাক্তারের ফি ঢোকাচ্ছিস তুই আমার ভিতরে, এসব কি কোনো শিল্প? দ্যাখ আমার কি অবস্থা? কোনো অলঙ্কার নেই শরীরে, ত্বক মোলায়েম করা মলম, হাল ফ্যাশানের পোশাক, প্রসাধনী বাজার চালু চলার ভঙ্গি, বলার স্থাপত্য, ঠাট-বাট কিছুই ব্যাবহার করতে দিস না আমাকে। শিল্প বলতে যে সংজ্ঞা সুত্র আছে আর সুধী সুশীলরা যেরকম বলে তার কিছুই নাই আমার ভিতরে, কোনো অনুমোদিত ব্যাকারণ-অভিধান বা বিধান সব বিচারে আমি অশুদ্ধ। আমার ভিতরে এমন সব পরিকল্পিত বিষয় আর লোকজন জড় করেছিস যাদের শরীর কথা আচরণের ভিতরে কোনো ¯েœহ জাতীয় পদার্থ নেই, যে কারণে শক্ত দড়া দড়া পেশি তার নীচে শক্ত হাড়ের কাঠাম ছাড়া কোনো কমনীয়তা নেই আমার। চকচক করি না আমি, পাশাপাশি রাখলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে পার্থক্য কি অসীম? বাজারী গল্প কি সুন্দর সাজানো পরিপাটি, চলতি রুচি এবং সবার মনোরঞ্জনের ক্ষমতাঅলা। তারা তেল-তেলে মসৃণ, আমি খসখসা লাবণ্য প্রভাহীন। তারা ঠান্ডা মোহময় আলো, আমি ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুন, চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ঙ্কর উত্তাপ। তাদের শরীরভরা অলঙ্কার, প্রেম-অভিসার-হাসি-কৌতুক-নীতিকথা-অনুষ্ঠান-বাদ্য-বাজনা-বিয়ে আর গভীর দুঃখ দুঃখ বিরহে বাজার আলো করে রেখেছে তারা। কতো খরিদ্দার তাদের? আমার শরীর থেকে তাজা বুনো গন্ধ ওড়ে, ছড়িয়ে যায় ভদ্রোলোক সুশীল সুধীজনের চোখ-মুখ-ভ্রু কুচকে দেয়, আমার গন্ধ পেলেই তারা দ্রুত সটকে পড়ে।’

‘পুঁজি আর প্রতিষ্ঠান যাকে বশ করতে পারে না তার নামে কুৎসা রটায়, মনে রাখিস তুই কারও বিনোদন বা অলঙ্কার না। কারও ধান্ধার উপকরণ বা কৌশল তুই না। দা, কুঠার, লাঙ্গল, বল্লম, কলম, কাস্তের মতো জীবনের অনিবার্য তুই। শূন্য ঘণ্টারও আগে তুই, সময়হীন সময়ের একমাত্র। কোনো বচন বা লিঙ্গে তোকে বিবেচনা করা যায় না। নদী কি? নদী যা, গাছও তাই। সারা পৃথিবীর সবকিছু এমন কি পৃথিবী নিজেও তোর থেকেই উৎপত্তি। যদি বলো বাস্তবতা? বাস্তবতাকে বাস্তবতা দান করেছে বহুবহু গল্প। বিজ্ঞান হচ্ছে বাস্তবতা যাচাই নিমিত্ত আর বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে অঙ্কের উপরে আর অঙ্ককে শুরু হতে হয়।
মনেকরি-
ঢ= ঘোড়ার ডিম
ণ=করিমের বাপ
ঢ+ণ=আমাদের শ্রেণি উদাসীন শিশ্ন
এই মনে করাটাই গল্প, যার থেকে জন্ম সবার।’

দিন ফতুর হয়ে আসে, গল্প আর গল্পকার দ্রুত ডাল পাতার একটা ঝুপড়ি বানায়। গল্প খুশি হয়ে বলে ‘জায়গাটা অপরূপ নীরবতায় ভরা’
‘রাতে এখানে শিয়াল, বাগডাশা, চিতা, ভাল্লুক, অজগর স্বাধীন নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়, তাদের আচরণের মধ্যে প্রকৃতির গুপ্ত জ্ঞানের ব্যাখ্যা, আমি সেই সব দেখতে চাই’
‘তোর কি ভয় করে না?’
‘দায়িত্ব পালনে ভয় না পাওয়া আমার অভ্যাস। ঐ দূরে ডানে কাঁটাতারের জালে ঘেরা কালো একতলা ভবনে এক পেটমোটা মহিষ বসত করে, মহিষটাই এই বন-পাহাড়-ঝর্না আর চা বাগানের মালিক। মহিষটা সারাদিন খায়, ঘুমায় আর হুঙ্কার করে ধমকায়, এখানের মাটির সন্তানদের যারা মালিক ছিলো-এই বন পাহাড় ঝরনা সংস্কৃতির, শুকরদের রাষ্ট্র তাদের ভিটে মাটি কেড়ে নিয়ে এই শুকর কে বানিয়েছে মালিক আর তাদের শ্রমিক, শুকরটা আদি মালিক মাটির সন্তানদের সব শ্রম মেধা রক্ত জীবনীশক্তি শুষে নিয়ে মুনাফা বানায়। আর দক্ষিণ দিকে ঐ শাদা দেয়াল ঘেরা সুরম্য পাথুরে ভবনটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক পুঁজির দেবতাদের অবকাশ যাপন কেন্দ্র। রাতে এখানের সবকিছু পাল্টে যায়।’
‘পাল্টে কি হয়?’
‘সেটাই দেখার জন্য থাকতে চাই’
‘ওসব দেখে আমাদের লাভ নেই, চল ফিরি, এখানে অনেক ধরনের বিপদ আছে’
‘বিপদযুক্ত না হলে নিজের সাথে ঠিকঠাক পরিচয় হয় না আর জানা হয় না নিজের সামর্থ’
‘বন্ধুরা তোর জন্য দুশ্চিন্তায় থাকবে, কাউকে সমস্যায় ফেলা উচিত না’
‘সমস্যা বিলাসে যারা ভোগে তাদের সমস্যা ফুরায় না কখনও’
‘এখন কি কোরবি?’
‘অপেক্ষা’
‘কার?’
‘ঘটনার’

গল্প শুকনা ডাল পাতা জড় করে। সন্ধ্যা হয়ে আসে, কোণা ভাঙ্গা চাঁদ আলোর ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে সবকিছু রহস্যময় অচেনা করেতোলে। নীরবতা চৌচির করে লম্বা একটা হাঁক ছড়িয়ে পড়ে শিয়ালের তারপর কাছে দূরে একটার পর একটা, মুহূর্তে সন্ধ্যাটা থৈ থৈ করতে থাকে শেয়ালের হাঁকে, তার ভেতর থেকে গাছ পাতা ঝোপ ঝাড় ফিসফাস ফুসুর ফাসুর শুরু করে…

গল্প গল্পকারকে বলে ‘রাত্রী সব কিছু পাল্টে ফেলছে হয়তো আমাদেরও পাল্টে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াবে। এখনও সময় আছে চল ফিরি’
‘বনভূমির রাত্রী লক্ষ লক্ষ বছরের অভিজ্ঞতায় ভরা, যুগ যুগান্তরের হাজার লক্ষ গল্প ডুবে আছে এইসব রাতের ভিতরে, হয়তো সেসব গল্প রাতে জেগে ওঠে, তার দু একটা জানার জন্যই আজ রাতে এখানেই থাকতে চাই’

হাওয়া বইতে শুরু করে গাছেরা আদ্দিকালের নানান ইঙ্গিত ভরা নিজস্ব ভাষার গান জোড়ে মিহি সুরে। ঝোপের ভিতরে ঝিকমিক জ্বলে পশুদের চোখ, রাতচরা পাখিরা ডাক ছাড়ে এক একজন এক এক স্বরে কাছে দূরে ছড়িয়ে। গল্পকার বলে গল্পকে ‘চল পুঁজির দেবতাদের ভবনে দেখি কি হচ্ছে’
‘বিপদ আসছে, সারা বন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে, মাংশাসী পশুরা আমাদের ঘিরে ফেলেছে, আমরা এখান থেকে বের হলেই তারা রাতের খাবার খেয়ে বিশ্রাম করতে যাবে।’
‘তাতে আমাদের অসুবিধা কি?’
‘তুই কি চাস আমরা আজ পশুদের রাতের খাবার হোই?’
‘ভয় যাদের দখল করে তাদের বিভ্রান্তিতে ভরা দুশ্চিন্তার বাস্তবের সাথে কোনো সম্পর্ক থাকে না’
‘আমার চিন্তা মিথ্যা হলে আমিই সবচে’ খুশি হবো কিন্তু তা হবে না পশুরা এখানে হানা দিবে যে কোনা মুহূর্তে’
‘সেজন্যইতো চল ওই ভবনে ঢুকে যাই’

তারা গাছ পাতার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসা চাঁদের আলোয় দেখে দেখে এগিয়ে যায়, হঠাৎ তাদের খুব কাছে লাফিয়ে ওঠে পশুর গর্জন। আতঙ্ক তাদের তাড়িয়ে সারা গায়ে মোটা মোটা শিকড় পেঁচানো এক গাছে তুলে দেয়, তারা গাছের উচু ডালে চুপচাপ বসে থাকে ভয় ভাবনায় ধুকতে ধুকতে। নিচে পশুদের লড়াই শুরু হয় ঝোপঝাড় দুমড়ে গুড়িয়ে। হুঙ্কার দাপাদাপি অজগরের হিস্হিস্ রাতটাকে বিভীষিকায় ভরে ফেলে…

হঠাৎ পশুদের চুপ করিয়ে এগিয়ে আসে এক সারি গাড়ির তীব্র খোঁজারু আলো। মোট ছয়খানা গাড়ি এসে থামে আন্তর্জাতিক পুঁজির দেবতাদের অবকাশ যাপন ভবনের সামনে, ঝন্ঝন্ শব্দে খুলে যায় বিশাল লোহার দরজা। প্রথমে গাড়ি থেকে নামে শাদা পোশাকের পুঁজির দেবতারা, তাদের হাত ধরে নামে ঝলমল পোশাকের বিজ্ঞাপনের পরীর দল। তারা ভবনের ভিতরে ঢোকে আর ভবনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
গল্পকার গল্পকে বলে ‘চল দেখি পুঁজির দেবতা পরী আর শুকররা কি করে।’
‘নীচে নামলেই পশুরা আমাদের খেয়ে ফেলবে’
‘কতক্ষণ বসে থাকতে হবে?’
‘সবকিছু আগের অবস্থায় না ফেরে যতক্ষণ’
‘সে কি আর হবে?শুনেছি কোনো কিছুই আগের অবস্থায় ফেরে না?’
‘বস্তু ফেরে না, চিন্তা এবং পরিস্থিতি ফেরে, বৃষ্টির একই ফোটা দুইবার পড়েনা কিন্তু বৃষ্টিতো বার বার পড়ে’
‘বিজ্ঞাপনের পরীরা কোথায় থাকে?’
‘সিন্ডিকেটের লালসা বশিকরণ বানিজ্যিক মনোরঞ্জন, বিপনন অধ্যায়ের সাথে তাদের যুক্ততা’
‘দেবতারা কোথায় থাকে?’
মূল সিন্ডিকেটের দ্বিতীয় উপকরণ সমন্ময় বিষয়ক প্রপগান্ডা পরিবেশনের অংশ, নিয়ন্ত্রক সমীকরণ ব্যাবস্থাপনার আবরণ সিন্ডিকেটের দৃশ্যহীন দরজা, সিন্ডিকেটের আদেশ নির্দেশ প্রদান ক্ষমতা, তার পরিচালকও বটে’
‘সিন্ডিকেট কি?’
‘একটা গল্প, বানানো কাহিনী। যার সাথে যুক্ত করা হয় আরো আরো ক্ষমতার গল্প’
‘সাধারণ মানুষদের বশে রাখা শোষণ করার জন্য সিন্ডিকেটের মূল উপকরণ এবং মাধ্যম কি?’
‘বিভিন্ন বাহিনি, রাষ্ট্র, আইন, জেলখানা, ইশকুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পাগলা গারদ, ধর্ম, মূর্খতা, হুজুগ, মিডিয়া, লোভ, ভয়, বিশ্বাস, যুক্তি, অবকাঠামো ইত্যাদি ’
‘উদ্দেশ্য কি?’
‘মুনাফা, মুনাফা এবং মুনাফা’
‘প্রথম কে?’
‘আমি। সর্বত্র বিরাজ করি, আমির সাথে যুক্ততা সবার, আমিই পাল্টে দেই প্রেক্ষাপট, নিজেকে প্রত্যাহার করলে সবার সব অভিজ্ঞতা, সামনের সবকিছু অন্ধকারে ঢেকে যাবে। বিগব্যাঙ কি? আমি। মনু-শতরূপা, এডাম-ইভ, কিমুন্তি-ফাকুরন, এমিবা, কার্বন যৌগ ক্রমবিবর্তন কি? আমি। আমি প্রত্যাদেশ, পরম সত্তা সব আমি, তুইও আমি কিন্তু আমি তুই না। কাঠ কি আগুন? না কিন্তু যতক্ষণ আগুন কাঠকে ছুয়ে থাকে ততক্ষণ সে আগুন দহন ক্ষমতা সহ। তোকে গল্প ছুয়ে যতদিন থাকবে ততদিন বছর মাস যুগ তুই জ্যান্ত, সবাই তোকে নিয়ে বলবে, তুই থাকবি সবার সামনে, সবার মাঝে আর তোর মাঝ থেকে আমি গুটিয়ে নিলে নিজেকে তুই শেষ। আমিই বর্ণমালা, আমিই ভাষা। বর্ণমালা কি?নির্দিষ্ট সংখ্যক বাঁকা, সোজা দাগ তার ভিতরে মহাশক্তি কোথা থেকে আসছে শক্তি? ধারনা দিয়ে গল্প দিয়ে নির্মান করা হয়েছে। বর্ণ নামের এই সোজা বাঁকা দাগ জুড়ে জুড়ে শব্দ আর শব্দের সাথে শব্দ জুড়ে জুড়ে দর্শন-যুক্তি-বিজ্ঞান-অর্থনীতি-বৈধ-অবৈধ-দখলের সুত্র-মুক্তির কলা-প্রত্যাদেশের পুঁথি জ্ঞানের গোডাউনসহ দুনিয়াদারির সবকিছু। এখন ভাষাকে ভেঙে তার জন্ম খুঁজতে গেলে পাবি প্রতীকের গল্প আর বস্তুগত ভাবে ইতিহাস ধরে খুঁজতে গেলে দেখবি-সে শুধু পাল্টে, পাল্টে ফেলে নিজেকে। প্যারাকে ভেঙ্গে পাবি বাক্য, বাক্যকে ভেঙ্গে একক হিসাবে পাবি শব্দকে আর শব্দকে খুলে খুলে পাবি সেই ব্যকা-বুকো-সোজা দাগ বা বণ। যার ভিতরে ধ্বণি‘র গল্প ভরা আর বর্ণকে ভেঙে গুড়ো গুড়ো করে পাবি বিন্দু, যা জুড়ে জুড়ে রেখা দাগÑদুগ, যার জন্ম ইতিহাস খুঁজতে গেলে পাবি বহু বহু গল্প। কামড়া-কামড়ি, খুন, দখল, মুনাফা, যুদ্ধ, বিপ্লব আর এ সম্পর্কিত যাবতীয়, মানুষের এ পর্যন্ত আসার ইতিহাস মানে ভাষার ইতিহাস। এ সবের গোড়াতে আমি, যা দিয়ে লেখো, আর যা লেখো, আর যা বলো, যা প্রকৃত ফতুর করো, আর যা সঞ্চয়করো, যে জন্য করো, আর করো না যে জন্য, যা সবই আমি। যা খুঁজে নিগে? তবে মনে রাখিস এই খোঁজাও আমি, আর যা খুঁজবি, তার যা খুঁজে পাবি, আর যা পাবি না- তাও আমি। আজ সকাল থেকে যা যা করে আর দেখে আসছিস, আবার কি সম্ভব আবার সেই সকালে ফিরে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে যা যা করেছিস, দেখেছিস তা সব করা আর দেখা? তার মানে চলে যাওয়া সময়ের কিছুই আর নেই। এখন শুধু তার কাহিনী বা গল্প আছে। সকালের গল্প হয়ে, সামনে সন্ধ্যা, পর সকালের গল্পের মধ্যে ঢুকবো আর বর্তমান পূর্ববর্তী গল্প হয়ে উঠবে, আমাকে ব্যাবহার করে সবাই ধন সম্পদ ক্ষমতার মালিক হয় আবার আমাকে ব্যাবহার করেই সংগঠিত হয় মুক্তির মহাবিপ্লব। তুই কি ভাবে কোন প্রেক্ষিতে আমাকে ব্যাবহার করবি সেটা তোর ব্যাপার। ’

হঠাৎ ভবনের চারপাশ কাঁচে ঘেরা দোতলা হলরুম চারপাশের সবকিছুকে অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে ঝলমল আলোয় ভেসে ওঠে, তার ভিতরে পুঁজির দেবতা আর বিজ্ঞাপনের পরীরা জোড়ায় জোড়ায় একজন আর একজনকে জড়িয়ে চাটা-চাটি কচলা-কচলি শুরু করে, মুহূর্তে বিজ্ঞাপনের পরীরা কুমির আর পুঁজির দেবতারা দাঁতাল শুকরে পরিণত হয়। গল্পকার গল্পকে বলে ‘কি করে এটা হলো?’
গল্প হেসে বলে-‘যৌন মিলনের মগ্নতা সব মুখোশের প্রতিরোধ ধ্বংস করে যে যা-তাকে তার স্বরূপে প্রকাশ করে।’

হঠাৎ নাকাড়া আর রণসিঙা বেজে ওঠে বিপুল অহঙ্কারে, সাথে সাথেই উত্তর দিকের বনভূমি হটিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জনপদ বাজার আর বহু বহু মানুষের চিৎকার-চেচামেচি কোলাহল জেগে ওঠে।

গল্প ফিস ফিসিয়ে বলে ‘নউরশ্যামদের গল্প জেগে উঠেছে’
বহু মানুষ জড় হয়েছে। তার মাঝে সেকেলে লম্বা নলের বন্দুক হাতে সবুজ ঢিলাঢালা পোশাকের সৈন্যরাও আছে আর অন্যান্য মানুষদের হাতে তলোয়ার, তীরধনুক, বল্লম তারা প্রত্যেকে চরম উত্তেজিত আর বিশৃঙ্খল চিৎকার করে কোথাও যাবার জন্য অস্থির। একটা উঁচু মাটির ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে মাথায় পাগড়ি পরা রাজা কিছু বলার জন্য সবার উদ্দেশ্যে হাত তোলে। সবাই চুপ করে কিন্তু সে কিছু বলার আগেই গাছের উপর থেকে নজরদারি করা এক সৈনিক হাঁক দেয় ‘নফরহাদু, নফরহাদু, হুদামুর হুদামুর। গল্পকার জিজ্ঞেস করে ‘সে কি বলছে?’
গল্প বলে ‘সে বলছে দখলদার, দখলদার হুশিয়ার!হুশিয়ার!’
রাজা সবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে ‘রাকুউদারভু হুদামুর নরুদ কাদুম দেনকুব গোফাকুর উখার নহরম রাকুউদারভু’
গল্প অনুবাদ করে ‘রাজা বলছে যুদ্ধ করো, দখলদারদের নিñিন্ন করো, হয় স্বাধীনতা না হয় মৃত্যু যুদ্ধ করো’

সহসাই লোহার শীরস্ত্রান চকচকা আধুনিক বন্দুক-মেশিনগান, সজ্জিত দখলদার সৈন্যদের দেখা যায়। তারা চারপাশ থেকে আক্রমণ করে। নউরশ্যামরাও হুঙ্কার দিয়ে তাদের ট্রাডিশনাল পদ্ধতিতে বিপুল বিক্রমে সামনা-সামনি পাল্টা আক্রমণ কওে, দখলদারদের প্রতিরোধ করে। খুব কম সময়ে দখলদারদের উন্নত অস্ত্র আর যুদ্ধ কৌশলের সামনে তাদের প্রতিরোধ ধ্বংস হয়ে যায়। পুরা এলাকা প্রতিরোধকারি যোদ্ধাদের লাশে ভরে ওঠে। তাদের রাজারও মৃত্যু হয়। নউরশ্যাম যোদ্ধাদের একটা অংশ দখলদারদের বেষ্টনি গুড়িয়ে পালিয়ে যায়।

গল্প গল্পকারকে বলে ‘নউরশ্যাম যোদ্ধাদের লড়াই বীরত্বপূর্ণ, মানবিক আবেগ থেকে উৎসারিত দেশ প্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে তারা জীবন উৎস্বর্গ করেছে। মানুষ হিসাবে তারা মহৎ কিন্তু মহত্ত্ব দিয়ে সেবা হয় যুদ্ধ বিজয় হয় না। যুদ্ধে যে পক্ষ যন্ত্র-ষড়যন্ত্র-শক্তিতে তুলনামুলক প্রবল হবে বিজয় তারাই অর্জন করবে। যুদ্ধের মানবতা হচ্ছে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করো, খুন করো, উতখাৎ করো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপক্ষে মূর্খ ও তুলনামুলক অশিক্ষিতরা লড়াই করে কোনো ভাবেই বিজয় অর্জন করতে পারবে না’

পরবর্তী ঘটনা একের পর এক সামনে আসে ক্রম অনুয়ায়ি মঞ্চ নাটকের অবিকল ।

দৃশ্য -১: পরাধীনতার প্রথম লজ্জা

দখলদার বাহিনী পুরা এলাকায় নিরিহ নিরস্ত্র মানুষের বাড়ি, বাজার দোকানে ব্যাপক লুটপাট চালায়, খুন করে বহু মানুষ, ধর্ষন করে বহু নারীকে, অনেক শিশুকেও তারা খুন করে ।

দৃশ্য-২: ষড়যন্ত্র

যেসব নউরশ্যাম যোদ্ধারা পালিয়ে গভীর অরণ্যে আশ্রয় নেয়, তাদের সাথে দেখা করে পেটুরজার নামে লম্বা চওড়া এক লোক। সে নিজের পরিচয় দেয় আন্তর্জাতিক শান্তি সহযোগিতা সিন্ডিকেটের অথরাইজড পার্সন। সে নউরশ্যাম যোদ্ধাদের বলে ‘আমরা তোমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করি। তোমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা সহযোগিতা কোরতে চাই।’
‘কি ভাবে, কি ধরনের সহযোগিতা?’
‘আধুনিক অস্ত্র আর প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষজ্ঞ সহযোগিতা দিতে চাই। কিন্তু তোমাদের স্বাধীনতা তোমাদের লড়ে অর্জন করতে হবে। আমরা তোমাদের যে অস্ত্রগুলি আর আর যুদ্ধ সরঞ্জাম দিবো আন্তর্জাতিক মুদ্রামানে তোমরা তার মূল্য পরিশোধ করবে। তোমাদের প্রশিক্ষণ আমরা মানবিক কারণে দিবো। এছাড়া কয়েকটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তোমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে প্রচার চালানো হবে, এসবের জন্য আমারা কোনো টাকা নিবো না। তোমরা আমাদের প্রস্তাবে রাজী থাকলে একটা চুক্তি করে আমরা এখনই কাজে নেমে পড়তে চাই।’
‘অস্ত্র-গুলি-বারুদের দাম পরিশোধের কোনো সামর্থ আমাদের নাই’
‘এ ব্যাপারে তোমরা সামর্থবান হয়ে ওঠার জন্য আমরা তোমাদের যথাযথ সাহায্য করবো।’
‘কিভাবে?’
‘প্রথম চালান অস্ত্র আর প্রশিক্ষণ আমরা তোমাদের বাকিতে দিবো। তোমরা দেশের পশ্চিম অঞ্চল দখল করবে। তোমরা সরকার গঠন করবে, আমরা তোমাদের সমার্থন করবো। দুই চারটা দেশ তোমাদের সরকারকে স্বীকৃতি দিবে, সে ব্যাবস্থা আমরাই করবো। তোমাদের শত্রুরা যাতে তোমাদের এলাকা দখল করতে না পারে সে জন্য চারপাশে ভারি ভারি অস্ত্রের প্রতিরোধ ব্যাবস্থা গড়ে তোলা হবে। এ জায়গা হবে তোমাদের স্বাধীন-মূক্ত প্রধান ঘাঁটি। এখানের পাহাড়ি উপত্যকার সরেস উর্বর মাটিতে তোমরা ব্যাপক হারে মাদকের চাষ করবে, যা বিক্রি করে তোমাদের প্রচুর টাকা হবে। এছাড়া তোমাদের এলাকায় আমরা অস্ত্র ব্যাবসার একটা সিন্ডিকেট রুট বানিয়ে দিবো, যা নিয়ন্ত্রিত হবে তোমাদের মাধ্যমে। এখান থেকেও তোমাদের প্রচুর টাকা হবে। এসব টাকা থেকেই তোমরা তোমাদের যাবতীয় খরচ মেটাতে পারবে। মাঝে মাঝে তোমরা শত্রু এলাকায় অভিযান চালিয়ে ব্যাপক লুট করবে। নামি দামি ধণী লোকদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করবে। আর এই সব কাজ করার জন্য তোমাদের সামর্থ অর্জনের যাবতীয় সহযোগিতা আমরা করবো, এখন বলো তোমরা তোমাদের স্বাধীনতার লড়াই চালাতে চাও কি না?’
‘হ্যাঁ, আমরা লড়াই করতে চাই’
‘এটাই সত্যিকার মানুষের সিদ্ধান্ত, তাহলে তোমরা আমাদের প্রস্তাবে রাজী?’
‘হ্যাঁ রাজী’

 

দৃশ্য-৩: যুদ্ধে যে যন্ত্র সবচেয়ে বেশি ব্যবহারিত হয় তার নাম ষড়যন্ত্র

দোতলা ভবনের হলরুমে সবুজ বাতি জ্বলে ওঠে, সাথে সাথেই পুঁজির দেবতা আর বিজ্ঞাপনের পরীরা শুকর এবং কুমির থেকে পরিবর্তিত হয়ে তাদের পূর্বের মুখোশের চেহারায় ফিরে আসে।

দরজা খুলে হলরুমে ঢোকে দখলদার বাহিনীর প্রধান, সাথে এক পুরোহিত ওশান্তিতে নোবেলজয়ী আর তিন এনজিও মালিক, তারা পুঁজির দেবতাদের সালাম দেয়। পুঁজির দেবতারা তাদের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করে, তারা সবাই একই ভঙ্গিতে হাত চোখ মুখ নেড়ে কথা বলে, কিন্তু একটাই কণ্ঠস্বর শোনা যায় ‘আমরা যা বলছি তার ভিতর থেকে যে যার নির্দেশ এবং করণীয় বিষয় গ্রহণ করবে। যুদ্ধের প্রথম অধ্যায় শেষ হবার ভিতর দিয়ে দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। এখন নউরশ্যাম দেশে আমাদের অনুগত সরকার বানাতে হবে, একই সাথে তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেখানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যাবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পুঁজিবাদি গণতন্ত্র মানে যে কোনো একক জাতীর ঐক্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা, ব্যাক্তি স্বাধীনতার নামে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের হুজুগ তুলে একটা জাতীকে দল-উপদলে ভাগ ভাগ করে ফেলা। যেখানে প্রত্যেকেই তার নিজের মতটাকেই একমাত্র সঠিক বিবেচনা করবে। পুঁজিবাদি গণতন্ত্রে বিশ্বাসীরা সরল সত্য, ন্যায়, অন্যায় সনাক্ত ক্ষমতা হারাবে, তারা সব কিছু বিবেচনা করবে দলীয় দৃষ্টিতে। দলের ভিতরে থাকবে উপদল, ব্যাক্তি কেন্দ্রিক, সর্দার কেন্দ্রিক, হিংস্র ভাগা ভাগি খেয়ো-খেয়ির উম্মত্বতা দখল করে রাখবে, সবাইকে যার কারণে তারা তাদের সবার জন্য ভালো এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে না। তাদের পরস্পর পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, সন্দেহ অমোচনীয় অবস্থায় বিরাজ করবে। তারা সারা সময় একজন আর একজনকে বা একদল আর একদলকে টেনে পিছিয়ে রাখবে। আমাদের বীর সৈনিকরা ফিরে আসবে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্ট আর প্রশিক্ষক থেকে যাবে। নউরশ্যামদের মাঝ থেকে আমাদের একটা চাকর শ্রেণি গড়ে তুলতে হবে, আর ওখানের কৃষকের সন্তানদের নিয়ে একটা বিশেষ ক্ষমতাশালি বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। আমাদের পরিকল্পনায় কোনো বাঁধা আসলে আমাদের অনুগত কৃষকের সন্তানরাই কৃষকদের উপর গুলি চালাবে।

তাদের মাঝ থেকে আমাদের পণ্যের ডিলার শ্রেণি গড়ে তুলতে হবে। তারা আমাদের পণ্যের বাজারে পরিণত করবে সারা দেশটাকে। আমরা সব কিছু বিক্রি করবো। অস্ত্র, ঔষধ, কাপড়, সুঁই-সুতা থেকে, বিনোদন, যন্ত্রপাতি, শিক্ষা, যৌনতা সবকিছু। আমরা তাদের নৈতিক মানবিক চরিত্র ধ্বসিয়ে দেবো, তাদের জীবনকে বানাবো নির্মম ব্যাক্তিকেন্দ্রিক ভোগমুখি। তাদের খনি বন্দর অন্যান্যা ব্যাবসা বানিয্য সব থাকবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে।

যারা নতজানু হয়ে বিশ্বাস স্থাপন করবে, ভাগ্যে তারা সুপথের পথিক হিসাবে বিবেচিত হবে। তাদের জন্য খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, বিনোদন যোগান দিতে হবে ততটুকু, যতটুকু হলে তারা বেঁচে থাকে। তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে আর তাদের শ্রম মেধা সব নিংড়ে বের করে নিয়ে মুনাফা বানাতে হবে। যারা অমান্য করে, নতজানু হয় না, মেনে নেয় না ভাগ্যের বিধান, লড়াই করে তারা প্রকৃত বিপথগামি। তারা হারিয়ে যাবে। তাদের কতকের লাশ পড়ে থাকবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ক্ষত বিক্ষত টুকরো টাকরা হয়ে, মোটেই পাওয়া যাবেনা কতকের হদিস। এসব হচ্ছে সিন্ডিকেটের ক্ষমতার নিদর্শন। যা দেখে মানুষেরা অনুধাবন করতে পারে না মান্য করার পরিণতি। কারও কারও জন্য প্রকাশ্য আইন জেলখানা, পাগলাগারদ। এনজিওরা সাহায্য দিবে অসহায় দুঃস্থদের। তাদের কাজ কখোনও শেষ হবে না কারণ আমাদের সিসটেমের মধ্যে রয়েছে-অসহায় ও দুঃস্থ তৈরি হবার শর্ত। পুরোহিতরা মহা আড়ম্বরে প্রচার করতে থাকবে স্রষ্টার মহত্ব, তার ন্যায় বিচার, নানান অলৌকিক কাহিনী কারণ ধর্ম সব সময় সব যুগে আমাদের পক্ষে। সেখানে বলা আছে মানুষের ধন-সম্পদ সব স্রষ্টার ইচ্ছায় বরাদ্ধ হয় এ ব্যাপারে মানুষের কোনো হাত নাই। দরিদ্রদের উচিৎ ভাগ্যে বিশ্বাস করে নতজানু হয়ে ধৈর্য্য ধরে দুনিয়ায় তার নির্ধারিত কাজ করে যাওয়া সততার সাথে। তাহলে সে পরকালে অনন্ত সুখের স্বর্গে প্রবেশ করবে। এসব কথা প্রচার করবে পুরোহিতরা। আপনারা এখন যান এবং যে যার দায়িত্ব পালন করুন। ’

দৃশ্য-৪: শেষ হয় না যে গল্প

শান্তি সহযোগিতা সিন্ডিকেটের অথরাইজড পার্সন পেটুরজার দোতলা ভবনের দরজা খুলে ভিতরে ঢোকে। পুঁজির দেবতাদের সালাম দেয় তারপর বলে ‘নউরশ্যাম যোদ্ধাদের সাথে কথা বলা হয়েছে। তাদের আবেগ উস্কে দিয়ে যুক্তিপূর্ণ প্রলোভন প্রয়োগ করে তাদের বশ করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, আমরা তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করবো। তারা মাদক উৎপাদন করবে আর আমাদের অস্ত্রের দাম পরিশোধ করবে। একই সাথে আমাদের অস্ত্র ব্যাবসায় তারা আমাদের পথ হিসাবে কাজ করবে।’

আবারও পুঁজির দেবতারা সবাই বলে একই হাত-চোখ-মুখ ভঙ্গিতে কিন্তু একটাই ফ্যাসফেসে কণ্ঠ শোনা যায়। ‘কাজ শুরু হয়ে গেছে নউরশ্যাম রাষ্ট্রের বৈধ গণতান্ত্রিক সরকার গড়ে তোলার। একই সাথে গড়ে তোলা হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন বাহিনী। খুব শীঘ্রই আমাদের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনা হবে। আমরা নউরশ্যামদের আমাদের অনুগত বৈধ সরকারের কাছে অস্ত্র আর আর যুদ্ধ সরঞ্জাম বিক্রি করবো। একই সাথে তাদের সরকার বিরোধী যোদ্ধাদের কাছেও অস্ত্র আর যুদ্ধ সরঞ্জাম বিক্রি করবো। দু’পক্ষই আমাদের খরিদ্দার। তারা ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ করবে, আমরা যুদ্ধটা বাঁচিয়ে রাখবো। যুদ্ধ তাদের অস্থির করে রাখবে, তাদের সব কিছু করে রাখবে অনিয়ন্ত্রিত আর চরম অনিশ্চিত। আমরা তাদের খনি বন্দরসহ অন্যান্য ব্যাবসা বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ করবো। তুমি এখন যাও তোমার কাজ শুরু করো। যখন তোমার যা করতে হবে সময় মতো তার নির্দেশ দেয়া হবে।’
সে পুঁজির দেবতাদের সালাম দিয়ে বেরিয়ে আসে।

দোতলা ভবনের হলরুমের বাতি নিভে যায়। পুঁজির দেবতারা বিজ্ঞাপনের পরীদের সাথে নিয়ে ভবন থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠে আর গাড়ি বহর যে পথে আসছিলো সে পথেই চলে যায়।

পূর্ব দিগন্তে অন্ধকার ফিকে হতে শুরু করে। খুব দ্রুত নউরশ্যামদের গ্রাম-গঞ্জসহ পুরা রাজ্যটাই উবে গিয়ে সেখানে প্রতিস্থাপিত হয় বন-জঙ্গল। ভোরের পাখিরা গান গাইতে শুরু করে আর সারা এলাকা পাল্টে আগের অবস্থায় ফিরে আসে।

গল্প গল্পকারকে বলে ‘যে কাহিনী রাত জাগিয়ে তুলেছিলো তাকে আমি সময়ের কয়েদ থেকে মুক্ত করে তোর মাঝে ভরে মৃত্যুহীন অধ্যায়ে স্থাপন করতে চাই’
‘করো’
‘সমস্যা হচ্ছে আমরা এই গল্পের শেষটা পাচ্ছি না’
‘এই গল্প শেষ হতে বহু বহু যুগ লাগতে পারে। আবার সহসাই হতে পারে। বিষয়টাকে আমার সাথে যুক্ত করে নিয়েছি, সামনে যা যা ঘটবে তা সব আমার মাঝে চলে আসবে। এক সময় না এক সময় দুনিয়ার সাধারণ শ্রমজীবি মানুষেরা চিনবে দেবতা সেজে থাকা পুঁজির প্রভু দাঁতাল শুকরদের স্বরূপ। তখন মানুষেরা সব জড়তা, ভয় ঝেড়ে ফেলে সংঘবদ্ধ হবে। তাদের নিজেদের জীবনের পক্ষে।…আর উৎখাত করবে শ্রমডাকাত মানবতার এক নাম্বার দুশমন পুঁজির দেবতা শুকরদের, তখন এই গল্প একটা পরিণতি পাবে…’

 

Sayed Taufiq Ullah

গরু ও গাধা :  রচনা : হুমায়ুন আজাদ।

 

আজকাল আমি কোনো প্রতিভাকে ঈর্ষা করিনা

মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ এমন কি সাম্প্রতিক ছোটোখাটো

শামসুর রাহমানকেও ঈর্ষাযোগ্য ব’লে গণ্য করিনা;

বরং করুণাই করি। বড় বেশী ঈর্ষা করি

গরু ও গাধাকে; —–মানুষের কোনো পর্বে গরু ও গাধারা এতো বেশি প্রতিষ্ঠিত,

আর এতো বেশি সম্মানিত হয়নি কখনো।

অমর ও জীবিত গরু ও গাধায় ভ’রে উঠছে বঙ্গদেশ;

যশ খ্যাতি পদ প্রতিপত্তি তাদেরই পদতলে।

সিংহ নেই, হরিণেরা মৃত ; এ-সুযোগে বঙ্গদেশ ভ’রে গেছে শক্তিমান গরু ও গাধায়।

এখন রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর বাঙলায় জন্ম নিলে

হয়ে উঠতেন প্রতিপত্তিশালী গরু আর অতি খ্যাতিমান গাধা।

Continue reading “Sayed Taufiq Ullah”

Website Powered by WordPress.com.

Up ↑